‘ক্যান্সার’ কথাটি খুব ছোট হলেও তা একজন আক্রান্ত ব্যক্তিকে মানসিকভাবে পর্যুদস্ত করে
ফেলে। প্রাণঘাতী এই রোগ শরীরের নিয়মতান্ত্রিক বিষয়গুলোর ছন্দপতন ঘটায় এবং সেই সাথে
মানসিক স্বস্তি কেড়ে নেয়। ক্যান্সার সনাক্ত হওয়ার পর একজন রোগীর মিশ্র প্রতিক্রিয়া
হয়, যেমন ভয়, দুঃখ, রাগ ও দুশ্চিন্তার মত অনুভূতিগুলো কাজ করতে থাকে। সময়ের সাথে
সাথে একজন ক্যান্সার রোগী তার শারীরিক পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে
কিন্তু মনোবল বজায় রাখাটা তার জন্য খুব কঠিন হয়ে পড়ে।
ভয়
বিগত দশকে ক্যান্সার চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেকটা
উন্নত হয়েছে কিন্তু আজও ‘ক্যান্সার’ শব্দটি মানুষের কাছে একইভাবে ভীতিপ্রদ।
ক্যান্সারের ফলে শরীরে উপর কেমন প্রভাব পড়বে; ব্যক্তিগত, দাম্পত্য, পারিবারিক ও
কর্মজীবনে কেমন পরিবর্তন আসবে, চিকিৎসা এবং চিকিৎসা বাবদ খরচ কিভাবে জোগাড় হবে বা
কতদিন তা স্বচ্ছলভাবে চালিয়ে নিতে পারবে, চিকিৎসার ফলে কি কি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
হতে পারে, চিকিৎসা খরচ মেটাতে গিয়ে তার পরিবারের আর্থিক অবস্থার কি পর্যায়ে গিয়ে
দাঁড়াবে; নিজের দায়িত্ব কর্তব্যগুলো ঠিকঠাকভাবে পালন করতে পারবে কিনা-এরকম নানা
চিন্তা একজন রোগীর মনে অজানা ভয়ের সৃষ্টি করে।
দুশ্চিন্তা
ক্যান্সার আক্রান্তের বিষয়টি জানতে পারলে তা
এক ধরনের মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। আর এই মানসিক চাপের ফলে এড্রেনালিন নামক হরমোন
নিঃসৃত হয় যার ফলে দুশ্চিন্তার উদ্রেক হয়। এছাড়াও এই চাপ হার্ট রেট বাড়িয়ে দেয়,
অতিরিক্ত ঘাম হয়, মুখ শুকিয়ে যায় এবং রক্তচাপও বেড়ে যায়।
রাগ
রিপোর্টে যখন ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি
নিশ্চিত হয়, সর্বপ্রথম রোগীর মাথায় যে প্রশ্নটি খেলে, “আমিই কেনো?” প্রচন্ড রকম
রাগ হয় নিজের প্রতি বিশেষত আপনি যদি অ্যাডভান্সড লেভেলের ক্যান্সার রোগী হয়ে
থাকেন। শুধু নিজের প্রতি নয় চারপাশের মানুষ এমনকি কখনো কখনো স্রষ্টার প্রতিও
প্রচন্ড রকম আক্রোশ তৈরি হয়।
মানসিক ধাক্কা
প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সারের কোন লক্ষণ
প্রকাশ পায় না। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলে বা অ্যাডভান্সড লেভেলে চলে গেলে বেশিরভাগ
ক্ষেত্রে শরীরে ক্যান্সারের লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে থাকে। আপনার যদি শারীরিক কোনো
সমস্যা বা অন্যান্য রোগ না থেকে থাকে তাহলে এই আকস্মিক ক্যান্সার আক্রান্তের
সংবাদটি আপনাকে মানসিকভাবে মুহুর্তেই স্তব্ধ করে ফেলবে।
অপরাধবোধ
আপনি এক ধরনের অপরাধবোধে ভুগতে শুরু করবেন
এইটা ভেবে যে আপনি হয়তো আপনার পরিবার পরিজন বা কাছের মানুষের কাছে বোঝা হয়ে উঠবেন
এবং আপনার দায়িত্ব কর্তব্যগুলো ঠিকভাবে পালন করতে পারবেন না। আমরা সকলেই জানি
ক্যান্সার চিকিৎসা ব্যয়বহুল এবং পরিবারের আর্থিক অবস্থার উপর এর মারাত্মক প্রভাব
পড়ে; এই ভাবনা আপনার অপরাধবোধের জায়গাটাকে আরো প্রকট করবে। কিন্তু আপনাকে এটা মাথায় রাখতে হবে আপনি স্বেচ্ছায় বা কর্মফল
হিসেবে ক্যান্সারে আক্রান্ত হন নি।
দোষারোপ
আপনি হয়তো ভাবতে পারেন আপনার জীবনযাত্রার ধরন
এবং চিরাচরিত অভ্যাসগুলোর কারণে ক্যান্সার হয়েছে এবং এই কারণে আপনি নিজেকে দোষারোপ
করতে থাকবেন।
দুঃখ
এটা খুব স্বাভাবিক ক্যান্সারের আক্রান্তের
খবরে আপনি দুঃখ পাবেন। কোনো অসুখ তো আর কারো জন্য সুখ বয়ে আনে না। এই দুঃখবোধ
আপনাকে ভেতরে ভেতরে মানসিকভাবে ভেঙেচুরে টুকরো টুকরো করে ফেলবে কারণ আমরা সকলে
কমবেশি ক্যান্সারের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানি।
একাকিত্ব
সময়ের সাথে সাথে একজন ক্যান্সার রোগী ভাবতে শুরু করে সবাই আগের মত তাকে আর মূল্যায়ন করছে না অবহেলা করতে শুরু করেছে (যদিও বাস্তবচিত্রটা এমন নয়) এবং এর ফলে একজন রোগী মানসিকভাবে একাকিত্বে ভুগতে শুরু করে। যদি কখনো পরিবার বা বন্ধুবান্ধব তার কোনো কথা বুঝতে ভুল করে বা সেইরূপে কোনো কাজ করে তাহলে একজন রোগী ভাবে তাকে সবাই অবহেলা করছে তার কথাকে পাত্তা দিচ্ছে না। একাকিত্ববোধ তাকে ধিরে ধিরে সকলের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
আত্মনিয়ন্ত্রণ
হারিয়ে ফেলা
অকস্মাৎ অনাকাঙ্ক্ষিত এই ঘটনা ব্যক্তি মনের
অনুভূতিকে প্রচন্ডভাবে নাড়া দেয় এবং দৈনন্দিন কাজের উপর মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলে।
নিজেকে আপনার অসহায় মনে হবে। ‘কি করবেন আর কি করবেন না’ তা ভাবার চিন্তাশক্তি লোপ
পেয়ে যাবে। ক্ষণিকের জন্য হলেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে।