বিশ্বব্যাপী প্রতি ৫ জনের মধ্যে ১ জন পুরুষ এবং ৬ জনের মধ্যে ১ জন মহিলা তাদের জীবদ্দশায় কোনো না কোনো ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। স্ক্রীনিং, প্রাথমিক সনাক্তকরণ, টিকা এবং চিকিৎসায় উন্নতির বদৌলতে বর্তমানে অনেক ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর জীবন বাচানো সম্ভব হচ্ছে। যদিও কিছু ক্যান্সার দ্রুত সময়ে শনাক্ত করলে চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময় করা সম্ভব তবুও ক্যান্সার থেকে বাঁচাতে প্রতিরোধ-ই হচ্ছে সবচেয়ে কার্যকরী পন্থা। ক্যান্সার প্রতিরোধের নিয়মগুলি মেনে চললে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অনেকখানি কমিয়ে আনা সম্ভব।
ক্যান্সার নানাবিধ কারণে হতে পারে তবে এখন পরিবেশগত কারণ ও জীবনযাপনের ধরণকে অনেকাংশেই দায়ী করা হচ্ছে। ক্যান্সার প্রতিরোধ করার জন্য খাদ্যাভাস কিছুটা পরিবর্তন করলে অনেক উপকারী ভূমিকা রাখে। স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যতালিকা তৈরি করে তা মোতাবেক খাদ্যগ্রহণ করলে ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকটাই কমিয়ে ফেলা যায়।
এমন খাদ্যদ্রব্য বা নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করা উচিত নয় যেগুলোতে ক্যানসার হওয়ার উপাদান বা কারসিনোজেন্স রয়েছে। এটি দেহের কোষীয় বিপাকীয় পদ্ধতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কারসিনোজেন্স তৈরির অন্যতম কারণ হচ্ছে ধূমপান, টোবাকো এবং অ্যালকোহল গ্রহণ। এসব নেশা জাতীয় দ্রব্য ত্যাগ করলে ক্যানসারের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
এখানে এমন কিছু খাবারের নাম দেয়া হল যেগুলি ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে ভূমিকা রাখে,এবং ক্যান্সার প্রতিরোধে যে খাবার গুলি ত্যাগ ও গ্রহন সীমিত করতে হবে সেগুলি সম্পর্কেও জানানো হলো:-
শস্য, শাকসবজি, ফল এবং মটরশুটি সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহন :
শস্যদানা, শাকসবজি, ফল, ডাল, মটরশুটি এবং মসুর ডালকে দৈনন্দিন খাদ্যেতালিকায় একটি প্রধান অংশ হিসেবে যোগ করতে হবে। গবেষকরা বলেছেন গোটা শস্য খাওয়া কোলোরেক্টাল ক্যান্সার থেকে রক্ষা করে বলে শক্তিশালী প্রমাণ রয়েছে।
মাছ :
মাছ সব চাইতে ভালো ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের উৎস, বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ। এই ধরনের ফ্যাটি অ্যাসিড সমূহ দেহে ক্যান্সারের সেল গঠন প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে বেশ কার্যকরী।
রসুন :
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় রসুনের অন্যতম প্রধান উপকারিতা হচ্ছে এটি বিশেষ করে ক্লোন, স্টোমাক, ইন্টেস্টিনাল এবং প্রস্টেট ক্যান্সারসহ শরীরের বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার প্রতিরোধক হিসাবে কাজ করে। রসুন এমন একটি উপকারী ও শক্তিশালী খাদ্য যার
এন্টিব্যাকটেরিয়াল ধর্ম শরীরে ক্যান্সার কোষের ছড়িয়ে পড়াকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়।
হলুদ :
হলুদে কারকুমিন নামক এক ধরণের উপাদান থাকায় হলুদ রঙ পাওয়া যায়। এই কারকুমিন খুবই উপকারী এন্টি-অক্সিডেন্ট। কারকুমিন টিউমার কোষ ধ্বংস করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন।
ভেষজ খাবার :
কিছু ভেষজ জাতীয় খাবারে এন্টি অক্সিডেন্ট থাকে। যা ক্যানসারের কোষ ঝিল্লি তৈরি ব্ন্ধ করতে কার্যকরী। ভেষজ জাতীয় খাবার যেমন অশ্বগন্ধা, তুলসি, ত্রিফলা ইত্যাদি। তাই এ ধরনের খাবারের অভ্যাস করতে পারেন।
গ্রিন টি :
গ্রিন টি বা সবুজ চা ক্যান্সার প্রতিরোধে অনেক উপকারী। এই সবুজ চায়ে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্যাটচীন নামক উপাদান থাকে, যা বিভিন্ন ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে সক্ষম। গবেষণায় আরো দেখা গেছে গ্রিন টি টিউমার হওয়া প্রতিরোধ করে থাকে। সাধারণ চায়ের চেয়ে গ্রিন টি বেশি উপকারী।
যে খাবার গুলো গ্রহন ত্যাগ করতে / কমিয়ে ফেলতে হবে :
চিনিযুক্ত পানীয় বা বেভারেজ পান করা ত্যাগ করা :
চিনিযুক্ত পানীয় বা বেভারেজ স্থূলতা এবং ডায়াবেটিস হওয়ার মূল কারণ। ইউনিভার্সিটি অফ মিনেসোটা স্কুল অফ পাবলিক হেলথের গবেষণায় দেখা গেছে , চিনিযুক্ত পানীয় পানে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে প্রায় ৮৭ শতাংশ পর্যন্ত। তাই চিনিযুক্ত পানীয়/বেভারেজ যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে।
অ্যালকোহল সেবন সীমিত করা :
মদ্যপ পানীয় গ্রহণ মুখ, যকৃত, কোলোরেক্টাম এবং স্তনের ক্যান্সারের কারণ বলে শক্তিশালী প্রমাণ রয়েছে। প্রতিদিন মাত্র ১০ গ্রাম অ্যালকোহল পান করলেই ক্যান্সারের ঝুঁকি ৪-২৫% বেড়ে যায়।
লাল এবং প্রক্রিয়াজাত মাংস গ্রহন সীমিত করা :
লাল বা প্রক্রিয়াজাত মাংস ক্যান্সার কোষ গঠনে সাহায্য করে। লাল এবং প্রক্রিয়াজাত মাংস উভয়ই একের অধিক ধরনের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়, বিশেষ করে কোলোরেক্টাল ক্যান্সারের । প্রতিদিন ৫০ গ্রাম প্রক্রিয়াজাত মাংস খাওয়ার সাথে কোলোরেক্টাল ক্যান্সারের ঝুঁকি ১৬% এবং প্রতিদিন ১০০ গ্রাম লাল মাংস খাওয়ার সাথে কোলোরেক্টাল ক্যান্সারের ঝুঁকি ১২% বৃদ্ধি পায়। যেহেতু মাংস পুষ্টির একটি মূল্যবান উৎস বিশেষত প্রোটিন, আয়রন, জিঙ্ক এবং ভিটামিন বি ১২ এর, তাই প্রক্রিয়াজাত ও লাল মাংস সম্পূর্ণরূপে খাওয়ার বাদ দেয়ার পরিবর্তে অল্প পরিমানে খাওয়া উচিত।
ফাস্ট ফুড খাওয়া কমিয়ে দেয়া :
গবেষণায় দেখা যায় যে ফাস্ট ফুড এবং অন্যান্য প্রক্রিয়াজাত খাবারে উচ্চ পরিমাণে অস্বাস্থ্যকর চর্বি, স্টার্চ বা শর্করা রয়েছে। তাই এ ফাস্ট ফুড উচ্চ পরিমানে খেলে ওজন অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায় এবং অতিরিক্ত ওজন এবং স্থূলতার ফলে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের অনেকেই অপুষ্টিজনিত কারণে মারা যায়। চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে ক্যান্সার রোগীরা খাবারের প্রতি রুচি হারিয়ে ফেলে। তাই সঠিক খাদ্য ব্যবস্থাপনাই পারে ক্যান্সারের সাথে লড়াই করার শক্তি যোগাতে। তাই আমাদের সকলেরই খাদ্যতালিকায় বিভিন্ন পুষ্টিকর খাবার যোগ করা উচিত।