ক্যান্সার একটি দূরারোগ্য ব্যাধি হিসেবে পরিচিত। পুরোপুরি আরোগ্যলাভ সম্ভব না হলেও সুস্থতা ধরে রাখা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব। আর সেই জন্য প্রয়োজন সঠিক খাদ্য-পথ্য-জীবনাচরণ।
আমাদের দেশে ক্যান্সার সহ যে কোন রোগের রোগীদের অনেকের মধ্যেই সঠিক ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের প্রতি অসচেতনতা ও অবহেলা দেখা যায়। ঈদ এবং অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে সেই অবহেলা যেন হয়ে উঠে আরো ভয়ানক! রসনা তৃপ্তিতে প্রয়োজনের অধিক খাবার গ্রহন তখন সবার ক্ষেত্রেই ভয়াবহ হয়ে ওঠে ঘটে যা অসুস্থ ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী তো বটেই , পাশাপাশি সুস্থ মানুষদের ক্ষেত্রেও মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সৃষ্টি করে। তাছাড়া দেহ সুস্থ রাখার জন্য ব্যয়ামের অভাব তো রয়েছেই।
সামনে ঈদ উল আযহা, এসময় আমাদের চারপাশে গরু,ছাগল,খাসি,মহিষ,উট,ভেড়া ইত্যাদি পশু কোরবানী হয়ে থাকে। যার ফলে এই সময় প্রাণী হতে আহরিত মাংস গ্রহণও হয় অধিক। এই সকল পশুর মাংস লাল বিধায় চিকিৎসা বিজ্ঞানে এদের কে ‘রেড মিট’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। এই লাল মাংস দেহে উচ্চ রক্তচাপ,কোলেস্টেরল সহ বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করে আর ক্যান্সারের ঝুঁকি তো রয়েছেই,সাথে রয়েছে মৃত্যু ঝুঁকি।
তাহলে প্রশ্ন হতে পারে, তবে কী লাল মাংস একেবারেই খাবো না?”
উত্তর হবে, হ্যা,খাবেন। তবে নিয়ম মেনে। কিন্তু যাদের শারীরিক জটিলতা রয়েছে তাদের জন্য এড়িয়ে চলাই উত্তম। ক্যান্সার রোগীদের ক্ষেত্রে এই লাল মাংস বিভিন্ন প্রকার ঝুঁকি বাড়ায়,তাই তাদের জন্য প্রয়োজন বাড়তি সচেতনতা। যদি এড়ানো সম্ভব না হয় , সেই ক্ষেত্রে গ্রহণ করতে হবে খুব অল্প পরিমানে, বেশ কিছু নিয়ম কানুন মেনে।
যেমনঃ-
- প্রাকৃতিক ভাবে লালিত-পালিত পশুর মাংস হতে হবে;
- মাংসের টুকরো পাতলা , ছোট ও চর্বিমুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়;
- অল্প আঁচে প্রয়োজনে দীর্ঘ সময়ে রান্না করতে হবে। গ্রিল,স্মকড এমন রান্না করা রেড মিট কোনভাবেই ক্যান্সার রোগীদের খাওয়া যাবে না।
মাংস রান্নার আগে সিরকা, লেবুর রস, পেঁপে বাটা, টক দই ইত্যাদি দিয়ে ম্যারিনেট করে রাখা যায়। এতে তেল কম লাগবে এবং তাড়াতাড়ি মাংস সিদ্ধ হবে।প্রয়োজনে পেঁপে , মিষ্টি কুমড়া , আলু প্রভৃতি সবজি সহ মাংস রান্না করতে হবে, যেন মাংস খাওয়ার পরিমাণ কমানো যায়।
তবে দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এই যে, প্রাকৃতিকভাবে বড় হয়ে উঠা পশু পাওয়া কঠিন। পশু চারণভূমির অভাবে ফার্মে পালিত হয় এরা।খাবার হিসেবে এমন খাদ্য দেওয়া হয় যাতে রয়েছে বিভিন্ন প্রকার এন্টিবায়োটিক। এই এন্টিবায়োটিক পশুর দেহে সঞ্চিত থাকে। এই ধরনের পশুর মাংস গ্রহণ করলে মানবদেহে এন্টিবায়োটিক স্থানান্তরিত হয় যা স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করে। আর ক্যান্সার রোগীর ক্ষেত্রে তা হয়ে উঠে আরও ভয়াবহ। আবার কিছু কিছু সময় প্রক্রিয়াজাত মাংস ব্যবহার করা হয় যেটি সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করে।
এন্টিবায়োটিকের ক্ষতি এড়াতে পশু কেনার সময় যাচাই করা প্রয়োজন।পাশাপাশি প্রয়োজন সঠিক ভাবে রান্না।মাংস গ্রহণের সময় প্রাণীজচর্বি ও অধিক পরিমানে মসলা ব্যবহার পরিহার করা আবশ্যক। ডিপ ফ্রাই,গ্রীল,স্মোকড ইত্যাদি ভাবে রান্না করা যাবে না। গবেষণায় দেখা গেছে স্মোকড তথা ধোয়ার মাধ্যমে রান্না করা খাবার গ্রহণে ফুসফুসে ক্যান্সার সৃষ্টি হয়। ডিপ ফ্রাই,গ্রীলে অতিরিক্ত তেল মসলা ব্যবহার করা হয় যা ক্ষতিকর।পাশাপাশি অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় বর্জন করা উচিত।
কে কতটুকু খাবেন?
প্রাণীজ আমিষ তথা লাল মাংস মানবদেহের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অধিক পরিমানে গ্রহণ মারাত্মক শারীরিক সমস্যা ডেকে আনতে পারে। তাই এই বিষয়ে সচেতনতা ও জ্ঞান থাকা একান্ত জরুরী।দৈনিক গরুর মাংস খাওয়ার নিরাপদ মাত্রা হলো তিন আউন্স বা ৮৫ গ্রাম। তিন আউন্স মাংসে ২০০ কিলো ক্যালোরি থাকে, যা দৈনিক মাত্র ১০ ক্যালোরির জোগান দেবে। আর এই তিন আউন্স মাংসে কোলেস্টেরল মাত্রা ৫৩ মিলিগ্রাম। একজন সুস্থ ব্যক্তির দৈনিক নিরাপদ মাত্রা হলো ৩০০ মিলিগ্রাম এবং হার্টের রোগীদের ক্ষেত্রে জন্য ২০০ মিলিগ্রাম। তাই তিন আউন্স গরুর মাংস খাওয়া নিরাপদ। শুধু পরিমিত পরিমাণে খেলেই হবে না সুস্থ থাকতে হলে লাল মাংস নিয়ম মেনে রান্না করতে হবে। তেলের ব্যবহার কমিয়ে রান্না করতে হবে। ভুনা করে বেশি মসলাযুক্ত রান্না করা যাবে না।
খাদ্যের সাথে জীবনাচরণ
শুধু পরিমিত আমিষ গ্রহণ করলেই সুস্থ্যতা অর্জন সম্ভব নয়।জটিল রোগ ক্যান্সার শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে যখন এটি অনুঘটকের সংস্পর্শে আসে। খাদ্য অন্যতম প্রাথমিক অনুঘটক যা ক্যান্সার কোষকে দ্রুত হারে পুনরুত্পাদন করতে পারে। এটি প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্যকর খাবার সমন্বিত একটি ডায়েট আর সঠিক ব্যায়াম। সুস্থ্যতা অর্জনের জন্য এবং তা বজায় রাখার জন্য শাক-সবজি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিছু কিছু রোগের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সবজি গ্রহণে সীমাবদ্ধতা থাকলেও শাকে তা নেই। তাই সকলের উচিত সুস্থ্য থাকার জন্য প্রতিদিন শাক-সবজি গ্রহণ করা। তেল হিসেবে মাছের তেল, অলিভ অয়েল উত্তম। আর অসুস্থ রোগীদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী জরুরী চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা। ক্যান্সার বা অন্যান্য জটিল রোগের রোগীদের প্রায়শই বিভিন্ন চিকিৎসা বা থেরাপি চলতে থাকে।সেই সময় কিছু কিছু খাদ্য গ্রহণে সীমাবদ্ধতা দেয়া হয়।তাদের জন্য সেই নিয়ম মেনে চলা বাধ্যতামূলক। সুস্থ্ থাকার জন্য বয়সভেদে আলাদা আলাদা ব্যায়াম খুবই প্রয়োজন। হাঁটা সকল বয়সের মানুষের জন্য উপকারী। মন খুলে হাসতে পারাও হৃদপিণ্ডের জন্য ভালো। তাছাড়া রয়েছে নানান রকম যোগ ব্যায়াম। এগুলো যেমন শরীরিকে সুস্থ্য রাখে,ঠিক তেমনি মন ভালো রাখে।
অনুশাসন-ঔষধ-খাদ্য এই তিনটি শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা সর্বোপরি সুস্থ জীবনের জন্য জরুরী। তবে তা সঠিক মাত্রায় হওয়া আরও বেশী জরুরী। তাই ঈদ আনন্দ উদযাপন করার সময় যেন স্বাস্থ্যঝুঁকি না বাড়ে সেদিকে নজর রাখা একান্ত প্রয়োজন।