মলাশয়ের ক্যান্সার (ইংরেজি: colorectal cancer) হচ্ছে এক ধরনের ক্যান্সার যা দেহেরমলাশয়, মলনালী (বৃহদান্ত্রের অংশ) বা অ্যাপেন্ডিক্সে অংশে অনিয়ন্ত্রিত কোষবৃদ্ধির কারণে সৃষ্টি হয়। এটি কোলন ক্যান্সার , কোলোরেক্টাল ক্যান্সার, বৃহদান্ত্রের ক্যান্সার বা অন্ত্রের ক্যান্সার নামেও পরিচিত।
ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সারের ' গ্লোবোকন ২০২০ ' রিপোর্টের সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে, ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী প্রায় ১,৯৩১,৫৯০ টি মলাশয় ক্যান্সারের নতুন রোগি শনাক্ত করা হয় এবং প্রায় ৯,৩৫,১৭৩ জন এই অসুস্থতায় মারা গেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০২০ সালে মলাশয় ক্যান্সারের ২৭৫৩ টি নতুন রোগি পাওয়া গিয়েছে হয়েছে এবং ১৭৭২ জন মারা গিয়েছে।
মলাশয় ক্যান্সারে আক্রান্ত অনেকেরই রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো উপসর্গ দেখা যায় না। ক্যান্সারের আকার এবং বৃহৎ অন্ত্রে অবস্থানের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন লক্ষণ দেখা যায়। এ ক্যান্সারের সাধারন উপসর্গ গুলো হল -
* মলে ত্যাগের সময় রক্ত দেখা যাওয়া
* ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য
* পেটে ব্যথা বা দেহে এমন ব্যাথা যা সহজে প্রশমিত হয়না।
* ওজন হ্রাস
বয়স বাড়ার সাথে সাথে মলাশয় ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে এবং অন্যান্য ঝুঁকির কারণও রয়েছে। অন্যান্য ঝুঁকির কারণগুলির মধ্যে রয়েছে-
* প্রদাহজনক অন্ত্রের রোগ যেমন ক্রোনস ডিজিজ বা আলসারেটিভ কোলাইটিস। *কোলোরেক্টাল ক্যান্সার বা কোলোরেক্টাল পলিপের ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ইতিহাস।
দৈনন্দিন জীবনযাত্রার যেসব কারনে মলাশয় ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়তে পারে পারে তার মধ্যে রয়েছে-
* নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপের অভাব।
* পরিমানে কম ফল এবং সবজি গ্রহন করা।
* ফাইবার এবং উচ্চ চর্বিযুক্ত খাদ্য কম পরিমানে গ্রহন করা বা প্রক্রিয়াজাত মাংস অধিক পরিমানে গ্রহন ।
* অতিরিক্ত ওজন এবং স্থূলতা।
* অ্যালকোহল সেবন।
* তামাক সেবন।
৪৫ বছর বয়স থেকে নিয়মিত মলাশয় বা কোলোরেক্টাল ক্যান্সার শনাক্তকরন পরীক্ষা বা স্ক্রিনিংয়ের মধ্য দিয়ে গেলে এ ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
যেসব নিয়ম মেনে চললে এ ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানো সম্ভব তা হলো -
সঠিক খাদ্যতালিকা গ্রহন :
খাদ্য তালিকায় পরিবর্তনের মাধ্যমে মলাশয় ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানো যায় কিনা তা গবেষকরা পরীক্ষা করে দেখছেন। অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি কমাতে ( যেমন করোনারি আর্টারি এবং ডায়াবেটিস) চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা প্রায়শই পশুর চর্বি কম খাওয়া এবং ফল, শাকসবজি এবং গোটা শস্যের বেশি গ্রহনের পরামর্শ দেন। এ খাবারগুলো মলাশয় ক্যান্সারের সম্ভাবনাও কমিয়ে দিতে পারে।
স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন :
গবেষণা ইঙ্গিত দেয় যে শারীরিক কার্যকলাপ বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা মলাশয় ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে পারে।
সপ্তাহের বেশিরভাগ দিন ব্যায়াম করা :
বেশিরভাগ দিনে কমপক্ষে 30 মিনিটের ব্যায়াম করার চেষ্টা করা।
একটি স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা :
প্রতিদিনের ব্যায়ামের সাথে একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্যের সমন্বয় করে ওজন বজায় রাখতে কাজ করা উচিত। যদি কারও ওজন কমানোর প্রয়োজন হয়, তবে সেই ব্যক্তির উচিত ওজন কমানোর স্বাস্থ্যকর উপায় সম্পর্কে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা। ব্যায়ামের পরিমাণ বাড়িয়ে এবং প্রতিদিন গ্রহন করা ক্যালোরির পরিমান কমিয়ে ধীরে ধীরে ওজন কমানো উচিত।
অ্যালকোহল এবং তামাক সেবন ত্যাগ করা :
অতিরিক্ত ধূমপান এবং অ্যালকোহল গ্রহনে মলাশয় ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই এসব থেকে দূরে থাকলে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনাও কমে যায়।
মলাশয় ক্যান্সার প্রতিরোধ ও শনাক্ত করার অন্যতম শর্ত হল রুটিন স্ক্রীনিং, যা ৪৫ বছর বয়সে শুরু হওয়া উচিত। ডাক্তাররা মলাশয় ক্যান্সার শনাক্ত করার জন্য বেশ কয়েকটি পদ্ধতির পরামর্শ দেন, যার মধ্যে রয়েছে -
* ফ্লেক্সিবল বা নমনীয় সিগমায়েডোস্কোপি :
এই পরীক্ষায় ডাক্তার মলদ্বারে একটি ছোট, পাতলা, নমনীয়, আলোকিত টিউব প্রবেশ করিয়ে মলদ্বার এবং এর নীচের তৃতীয়াংশের ভিতরে পলিপ বা ক্যান্সার পরীক্ষা করে।
* কোলনোস্কোপি :
এটি ফ্লেক্সিবল সিগমায়েডোস্কোপির মতো, এতে ডাক্তার মলদ্বার এবং পুরো কোলন বা মলাশয়ের ভিতরে পলিপ বা ক্যান্সার পরীক্ষা করার জন্য দীর্ঘ, পাতলা, নমনীয়, আলোকিত টিউব ব্যবহার করে।
* সিটি কোলোনোগ্রাফি। (ভার্চুয়াল কোলনোস্কোপি) :
কম্পিউটেড টমোগ্রাফি (সিটি) কোলোনোগ্রাফি, যাকে ভার্চুয়াল কোলোনোস্কোপিও বলা হয়। এ পরীক্ষায় এক্স-রে এবং কম্পিউটার ব্যবহার করে পুরো মলাশয়ের ছবি তৈরি করা হয়, যা ডাক্তারের বিশ্লেষণের জন্য কম্পিউটার স্ক্রিনে প্রদর্শিত হয়।
কোলন বা মলদ্বারে বা মলাশয়ে পলিপ এর অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হয়। সময়ের সাথে সাথে, কিছু পলিপ ক্যান্সারে পরিণত হতে পারে। স্ক্রীনিং পরীক্ষা পলিপ খুঁজে পেতে পারে যাতে ক্যান্সারে পরিণত হওয়ার আগে তাদের অপসারণ করা যায়। স্ক্রীনিং প্রাথমিক পর্যায়ে মলাশয় ক্যান্সার শনাক্ত করতে সাহায্য করে।
গবেষণায় দেখা যায়, প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জন যাদের কোলোরেক্টাল ক্যান্সার প্রথম দিকে শনাক্ত হয় এবং যথাযথভাবে চিকিৎসা করা হয় তারা চিকিৎসার পাঁচ বছর পরেও সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকে এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন করে।